৩৬২ মনুচ্ছেদ
মনুর দল সভায় বসেছে
মনু একটা কাল আর কাল গোটা সময়ের নির্দিষ্ট একটা অংশ আর অংশ কখন সমগ্র হতে পারে না। তবু কাল পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে তার কিছু বাহক তৈরি করে যায় কিংবা হয়ে যায়। এইরকমের কিছু মানুষেরা মনুর উত্তরসূরি হিসাবে নিজেদের দাবি করে।
দৃশ্য ১-
"প্রকাশ্যে নারীজাতির দন্ত প্রদর্শন সমাজের আকাশে কালবৈশাখীর লক্ষণ "
সভাপতি মনুমশাই গম্ভীর গলায় বললেন,
" আমাদের ক্লজে ছিল মেয়েদের হাসি শুধু মাত্র অন্তঃপুরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে , কেননা হাসি একটি ছোঁয়াচে রোগের মতো, সারা সমাজ হাসি রোগে আক্রান্ত হয়ে যাবে আর আমাদের মতো ক্লাউন যারা, নিত্য হাসির খোরাক, তারা সর্বসমক্ষে নগ্ন হয়ে যাবে। "
“আমাদের সংস্কৃতিতে তাই হাসিরও সীমা আছে। অতিরিক্ত হাসি নারীর সৌন্দর্য কমায়, আর সৌন্দর্য কমলে সংসার ভেঙে যায় এবং তার আগে আমাদের কোমর ভেঙে যায়।”
তখন পেছন থেকে এক নবীন মনুবাদী হাত তুলে বলল,
“কিন্তু স্যার, এখনকার মেয়েরা সংসারের চেয়ে ক্রিকেটকেই বেশি ভালোবাসে। ওরা ব্যাট তুলে এমন ছক্কা মারছে যে সীমারেখা খুঁজে পাওয়া মুশকিল।”
সভাপতি চিন্তায় পড়লেন। তারপর ঘোষণা করলেন,
“তাহলে নতুন নীতিমালা আনতে হবে—
সবাই গম্ভীর হয়ে উঠল,
ঠিক তখনই সভার বাইরে টিভিতে খবর এল—“ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল বিশ্বকাপ জিতেছে!”
ঘর নিস্তব্ধ। কেউ জল চাইল, কেউ ঘাম মুছল।
সভাপতি মৃদু স্বরে বললেন, “ওরা জিতেছে? কিন্তু আমাদের অনুমতি ছাড়াই কেমন করে?”
এক তরুণ সদস্য বলল, “স্যার, এখন মেয়েরা নিজের অনুমতি নেয়না বরং অনুমতি দেয়।”
সভা ভেঙে গেল চুপচাপ।
বাইরে কিশোরী মেয়েদের ভিড় চিৎকার করছে—
“মনুর বাঁধনে ছিদ্র পড়েছে, এবার মনুর সভাকক্ষেই হাওয়া ঢুকবে!”
দৃশ্য ২ -
মনুর উত্তরসূরিরা আজ এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে গেছে।
বিষয় — “নারী স্বাধীনতা : আধুনিকতা না বিপদ?”
সভাস্থল — এক পাঁচতারা হোটেল, যেখানে কফির দামে একটা গোটা পাঠা কেনা যায়।
সভাপতি বললেন,
“আমরা আজ এমন এক সমাজে পৌঁছেছি, যেখানে মেয়েরা গাড়ি চালায়, গান গায়, রাজনীতি করে… কাল হয়তো আকাশেও উড়বে!”
(কেউ পেছন থেকে বলল— “স্যার, ওরা ইতিমধ্যেই উড়ছে, পাইলট হয়ে।” সভাপতি কেশে নিয়ে বললেন— “তা হলে আমাদের সভার প্রয়োজন আরও বেশি!”)
স্লাইডশো চালু হলো।
প্রথম স্লাইডে লেখা—“মনুর বাণী: নারীকে সবসময় রক্ষিত হতে হবে।”
তার পাশে ফুটে উঠল এক চিত্র— একজন নারী ড্রোন উড়িয়ে মোবাইল দিয়ে বক্তৃতা লাইভ করছে।
সভাপতি চমকে উঠলেন— “এটা কে লাগাল? এই ছবি আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে!”
তখনই দরজার বাইরে থেকে মৃদু গলার আওয়াজ—“ভয় পাবেন না, আমি-ই সেই ছবি।”
সবার দৃষ্টি ঘুরে গেল।
ভেতরে ঢুকল এক চকচকে রোবট। গায়ে ইস্পাতের ঝিলিক, চোখে নীল আলো।
সে নিজেকে পরিচয় দিল—
“আমি রোবট মনু, নারী সংস্করণ ver. ২.০।”
সভাপতি হতভম্ব— “তুমি তাহলে…?”
“হ্যাঁ,” বলল রোবট মনু, “আমার কোড লেখা হয়েছে আপনারা যে বইয়ে নারীর স্বাধীনতা বারণ করেছেন, সেই বই থেকেই। কিন্তু আমি সেখানে নতুন করে প্রোগ্রাম বানিয়েছি সেটাকে উল্টো করে পড়তে হবে !”
সবাই স্তম্ভিত। কেউ বলল, “উল্টো করে মানে?”
রোবট হাসল— “যেখানে লেখা ছিল ‘নারী সর্বদা রক্ষিতা’, আমি কোড করেছি ‘নারীই সর্বদা রক্ষক’।
যেখানে লেখা ছিল ‘নারীকে অধীন রাখো’, আমি বদলে দিয়েছি ‘নারীকে অধিকার দাও’।
"এখন দেখুন, সিস্টেম ক্র্যাশ করছে না, বরং আপডেট হচ্ছে!
কারণটা ভীষণ সিম্পল - অপেরেটিং সিস্টেম অলরেডি আপডেট হয়েছে, পুরোনো প্রোগ্রামকে এক্সেস করতে পারছে না। "
মনুর উত্তরসূরিরা ঘামতে শুরু করলেন।
সভাপতি বিড়বিড় করে বললেন,
“এবার মনে হয় আমাদেরও সফটওয়্যার আপডেট দরকার…”
রোবট মনু শান্ত কণ্ঠে বলল,
“আপনাদের মন হার্ডডিস্কে পুরোনো মনু সংস্করণ এখনো চলছে। ওটা আনইনস্টল করুন। না হলে সমাজ স্লো হয়ে যাবে, ব্যাক গীয়ার দেবে।”
তারপর সে ঘুরে বেরিয়ে গেল সভাকক্ষ থেকে।
পেছনে পড়ে রইল নীরবতা—
শুধু এক তরুণ মনুবাদীর কণ্ঠ শোনা গেল,
“স্যার, আমি তো বলেছিলাম, ওরা এখন প্রোগ্রামও নিজের মতো করে লিখছে!”
দৃশ্য ৩
মনুর উত্তরসূরিরা বনাম নতুন যুগের নারী –
“মনুর দল ও মহিলা ব্যাঙ্ক”
আজ মনুর উত্তরসূরিদের বিশেষ চিন্তা।
বেতন বাড়ছে না, অথচ ব্যাঙ্কে মেয়েদের জমা বাড়ছে প্রতিদিন।
সভাপতি ঘোষণা করলেন,“আজ আমাদের সভার মূল আলোচ্য— অর্থনীতির দিক থেকে নারীকে কীভাবে সংযমিত রাখা যায়।”
এক প্রবীণ মনুবাদী বললেন,
“আগে তো নারীরা ব্যাঙ্কে যেত গহনা জমা দিতে। এখন ওরা গহনা কেনে অন্যদের টাকা দিয়ে! এ কেমন বিপর্যয়?”
অন্যজন যোগ করলেন,
“আমাদের সময়ে মেয়েরা সঞ্চয় করত চাল, ডাল, এখন ওরা সঞ্চয় করে শেয়ার, ক্রিপ্টো, মিউচুয়াল ফান্ড!”
ঠিক তখনই পাশের চেয়ারে রাখা খবরের কাগজের হেডলাইন ঝলসে উঠল—
“মহিলা ব্যাঙ্কের নতুন স্কিম: নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দিচ্ছে ।”
সভাপতির মাথা ঘুরে গেল।
“মানে, আমরা এখন ওদের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছি?”
ক্লার্ক শান্তভাবে বলল,
“জি স্যার। ওদের নামেও তিনটে কোম্পানি রেজিস্টার হয়েছে—
‘ঘর থেকে গ্লোবাল’,
‘মনু-ফ্রি এন্টারপ্রাইজ’,
আর নতুনটা— ‘লক্ষ্মী ইজ মাই বস’। ”
মনুর দল স্তব্ধ।
একজন মৃদু গলায় বলল,
“আমরা তো ভাবতাম মেয়েরা অর্থের ব্যাপারে দুর্বল…”
তখন ব্যাঙ্কের দরজা খুলে ঢুকল ম্যানেজার — এক তরুণী, আত্মবিশ্বাসে দীপ্ত।
বলল,
“সার, আপনার লোন পাস হয়েছে। কিন্তু একটা শর্ত আছে — আপনাকে সেল্ফ-হেল্প গ্রুপের ট্রেনিং নিতে হবে।”
সভাপতি অবাক, “মানে?”
“মানে,” মেয়েটি হাসল, “আপনাদেরও শিখতে হবে কীভাবে সঞ্চয় করতে হয়, দলবদ্ধভাবে কাজ করতে হয়, আর ব্যাঙ্ক ব্যালান্স দেখেও অহংকার না করতে হয়।”
মনুর দল তখন নতমুখে ফর্মে সই করছে।
কেউ বিড়বিড় করে বলছে, “মনু তো বলেননি, এমনও দিন আসবে যে নারীর কাছ থেকে আমরা ‘ঋণ নেবার বিষয়ে শিক্ষা’ নেব!”
ম্যানেজার মৃদু হেসে বলল,
“মনু বলেননি ঠিকই, কিন্তু সময় বলেছে— ‘যে নারীকে তুমি বশ করতে চেয়েছিলে, সে আজ অর্থনীতির ভাষা লিখছে।’ ”
মনুর সভা এবার ম্লান। কেউ আর তর্ক করছে না।
শুধু এক তরুণ সদস্য নোটবুকে লিখে রাখছে—
“আগামী সভার বিষয়: নারীকে থামানো যায় না— এখন অন্তত বুঝে নেওয়া যাক!”
দৃশ্য ৪
“মনুর দল ও সংসদ ভবন”
আজ সংসদে বিশেষ অধিবেশন।
বিষয় — “ভারতীয় সমাজে নারী নেতৃত্বের উত্থান”।
মনুর উত্তরসূরিদের ঘাম ঝরছে কোটের ভেতর।
সভাপতি বললেন,
“এটা তো আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র!
যেদিন সংসদে নারীরা বক্তৃতা শুরু করবে, সেদিনই মনুর শাসন শেষ!”
অন্যজন মৃদু স্বরে বলল,
“স্যার, এখন তো সংসদে মহিলা সদস্যদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। ওরা কেবল কথা বলে না, ভোটও দেয়।”
মনুমশাই গম্ভীর মুখে বললেন,
“ওরা ভোট দিক, কিন্তু আমাদের মতো করে দিক। মানে, আমাদের অনুমতি নিয়ে।”
ঠিক তখনই স্পিকার ঘোষণা করলেন—
“এখন বক্তব্য রাখবেন সম্মানীয়া সাংসদা সুবর্ণা দেবী — যিনি গ্রামের প্রাইমারি স্কুল থেকে উঠে এসে আজ সংসদে মন্ত্রী।”
সুবর্ণা দেবী উঠলেন,
গলায় দৃপ্ত স্বর—
“আমি এসেছি সেই ঘর থেকে, যেখানে মনুর দল বলেছিল মেয়েদের মুখে জ্ঞান মানায় না। আজ আমি দাঁড়িয়েছি এই সংসদের মঞ্চে, যেখানে ওদের মুখে আর যুক্তি মানায় না।”
তালির ঝড় উঠল।
মনুর উত্তরসূরিরা একসাথে পকেট থেকে তুলল কান বন্ধ করার তুলো।
একজন বলল,
“এরা এখন সংসদে দাঁড়িয়ে ‘মনুর ব্যাখ্যা’ দিচ্ছে, আর আমরা বসে ভাবছি সংসদ কি আদৌ সংসার থেকে আলাদা!”
অন্যজন যোগ করল,
“মনুর সময়ে সংসার ছিল চুলার পাশে। এখন সংসদেও ওরা আলো জ্বালাচ্ছে।”
স্পিকার মৃদু হাসলেন।
বলে উঠলেন—
“এই সংসদ এখন শুধু আইন নয়, ইতিহাসও লেখে। মনু যদি আজ বেঁচে থাকতেন, উনি বলতেন— ‘মনুবাদ এখন সংশোধনাধীন ধারা।’”
পুরো সংসদে হাসির ঢেউ। মনুর দল ফাইল গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বাইরে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করল, “আপনারা কি মনে করেন নারী নেতৃত্ব সমাজের ভবিষ্যৎ?”
সভাপতি বিড়বিড় করলেন, “আমরা এখন পূর্বতন ভবিষ্যৎ!”
পেছনে সংসদের ভেতর গম্ভীর কণ্ঠে সুবর্ণা দেবী বলছেন—
“যে সমাজ নারীকে বেঁধে রাখে, সে সমাজই শেষ পর্যন্ত নিজের বাঁধনেই জড়ায়।”
দৃশ্য ৫
“মনুর দল ও সামাজিক মাধ্যম”
আজ সকাল থেকেই মনুর উত্তরসূরিদের অফিসে কোলাহল। এক প্রবীণ মনুবাদী কাগজ হাতে দৌড়ে এসে বললেন— “বিপদ! আমাদের বাণী এখন মিম হয়ে ছড়াচ্ছে!”
সভাপতি চশমা মুছে বললেন,“কী বাণী?”
“‘নারী সর্বদা রক্ষিতা’— এই বাক্যটা কেউ মিম বানিয়ে লিখেছে— ‘নারী সর্বদা রক্ষিতা, বিশেষত ওয়াইফাই পাসওয়ার্ডে!’”
ঘরে হাসির ধ্বনি উঠল, কিন্তু মনুর দল গম্ভীর।
এক তরুণ সদস্য বলল, “স্যার, ফেসবুকে আমাদের গ্রুপে এখন মাত্র তিনজন আছে—
আপনি, আমি, আর একজন বট অ্যাকাউন্ট( একটা ভীষণ ফাস্ট সফটওয়্যার)!”
মনুমশাই হাহাকার করে উঠলেন—
“তাহলে সমাজ কোথায় যাচ্ছে?”
ঠিক তখনই টুইটারে ট্রেন্ড উঠল—
#মনুরবাঁধন পুরোনো হয়ে গেছে
তার নিচে এক মেয়ে লিখেছে—
“মনু বলেননি, কিন্তু সময় বলেছে— নারীকে অবরুদ্ধ রাখার অ্যাপস ডিলিট করা উচিত।”
মনুর দলের মাথায় হাত।
সভাপতি বললেন, “আমরা কি সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের ভাবমূর্তি ঠিক করতে পারি না?”
একজন বলল,
“স্যার, করেছি তো! আমরা একটা পেজ খুলেছি— মনু স্পিকস ।”
“তারপর?”
“ওখানে কেউ কিছু পোস্ট করলেই মেয়েরা নিচে কমেন্ট করে— 'পিতৃতন্ত্রকে আনইনস্টল কর! ’”
মনুমশাই কষ্টে বললেন,
“এই যে মেয়েরা এত তর্ক করছে, এদের সময় কোথা থেকে আসে?”
পাশের চেয়ার থেকে এক কণ্ঠ ভেসে এলো—
“আমাদের সময় নেই, মনু স্যার। আমরা সময় তৈরি করি।”
সবাই ঘুরে তাকাল।
দেখে এক তরুণী দাঁড়িয়ে আছে হাতে মোবাইল, চোখে আগুনের মতো আত্মবিশ্বাস।
সে বলল,
“আপনারা যখন কলম দিয়ে ইতিহাস লিখেছিলেন, আমরা তখন পড়ছিলাম সেটাই। এখন কিবোর্ড দিয়ে আমরাও লিখব— কিন্তু এবার নিজের গল্প।”
মনুর দল স্তব্ধ।
কারও ফোনে আবার নোটিফিকেশন এল—" তোমাদের তৈরী পেজটি 'মনু স্পিকস' রিনেম হয়ে নতুন নাম হয়েছে ' মনু শোন'। "
সবাই তাকিয়ে রইল নিঃশব্দে।
সভাপতি বিড়বিড় করলেন,
“মনে হচ্ছে এবার মনুবাদকে রিস্টার্ট নয়, শাটডাউন করতে হবে।”
বাইরে হাওয়ায় ভাসছে হাসির ঢেউ,
আর সেই সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার শিরোনাম—
“নারী এখন শুধু লাইক পায় না, ইতিহাসও রাইট করে!”
দৃশ্য ৬
এবার মনুর উত্তরসূরিদের যাত্রা পৌঁছল জ্ঞানের মন্দিরে —যেখানে একসময় তারা প্রবেশপথে লিখেছিল “নারীর প্রবেশ নিষেধ”,আর আজ সেই প্রবেশদ্বারেই লেখা— “ওয়েলকাম, প্রফেসর শক্তি !”
“মনুর দল ও নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা”
আজ মনুর উত্তরসূরিরা শিক্ষামন্ত্রকের সভায় হাজির।
বিষয়— “নতুন পাঠ্যক্রমে মনুর ভাবনা রাখা হবে কি না?”
সভাপতি গম্ভীর মুখে বললেন,
“আমাদের যুগে পাঠ্যবইয়ে লেখা ছিল— নারী মানেই স্নেহ, সংসার, সংযম। এখন শুনছি, বইয়ে নাকি লেখা হচ্ছে— নারী মানেই বিজ্ঞান, শক্তি, স্বাধীনতা!
এ কোন বিপর্যয়?”
এক প্রবীণ মনুবাদী বিড়বিড় করলেন,
“এবার যদি মেয়েরা শিক্ষক হয়, ছেলেরা ছাত্র হয়ে কবিতা মুখস্থ করবে—
‘আমি নারী, আমি পৃথিবী, আমি আলো।’”
তখন দরজা খুলে ঢুকলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভাইস চ্যান্সেলর —
ডক্টর অদিতি বন্দ্যোপাধ্যায়। হাতভর্তি ফাইল, মুখে মৃদু হাসি।
তিনি বললেন,
“স্যার, আপনাদের সময়ে শিক্ষা মানে ছিল মুখস্থ জ্ঞান। এখন শিক্ষা মানে প্রশ্ন করার সাহস।”
মনুর দল চমকে উঠল— “প্রশ্ন করার সাহস?”
অদিতি হাসলেন,
“হ্যাঁ। একদিন আপনারা বলেছিলেন, নারী যেন প্রশ্ন না করে।
আজ আমরা বলছি— নারী প্রশ্ন করবে, কারণ প্রশ্ন করলেই সমাজের পরীক্ষা পাস হয়।”
সভাপতি ক্ষীণ গলায় বললেন,
“তবে কি মনুর দর্শন বাদ দেওয়া হবে?”
অদিতি বললেন,
“না, বাদ নয়। আমরা ওটাকে ‘ঐতিহাসিক নথি’ হিসেবে রাখব।
যাতে ভবিষ্যতের ছাত্ররা দেখে বুঝতে পারে— কীভাবে বুদ্ধির বিবর্তন অন্ধ বিশ্বাসকে পেছনে ফেলে।”
মনুর দল হতভম্ব।
এক তরুণ সদস্য মৃদু স্বরে বলল,
“স্যার, আমাদের তো শেখানো হয়েছিল— নারী যেন গৃহেই থাকে।”
অদিতি হেসে বললেন,
“তাই তো এখন আমরাই শিক্ষকের ঘরে আছি, আর আপনারা ছাত্র!”
সবাই স্তব্ধ।
হঠাৎ প্রজেক্টরে দেখা গেল এক স্লাইড—
' এডুকেশন ভি- ২.০ - ফ্রম মনুস্মৃতি টু মনুস্মৃতি '
নিচে লেখা—
“এবার পাঠ্যবই বলবে, নারী মানুষ, দেবী নয়; পুরুষও মানুষ, দেবতা নয়।”মনুর দল নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।
কেউ বিড়বিড় করল, “মনুর বই পড়তে গিয়ে যদি আজকের মেয়েরা নিজেদের বই লেখে, তবে সত্যিই যুগ বদলেছে।”
অদিতি মৃদু হাসলেন,
“বদলায়নি স্যার, শুধু পৃষ্ঠা উল্টেছে।”
বাইরে ঘণ্টা বেজে উঠল— ক্লাস শুরু।
ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে লেখা—
“মনু বলেছিলেন, জানার সীমা আছে। নারীরা লিখছে— জানার সীমা নেই।”
দৃশ্য ৭
“মনুর দল ও বিবাহবাজার”
বিবাহবাজারে আজ ভীষণ ভিড়। ‘অনলাইন বিয়ের মেলা’ চলছে—
লাউঞ্জে ব্যানার টাঙানো— " সমতা হলো নতুন যৌতুক!"
মনুর উত্তরসূরিরা দলে দলে হাজির হয়েছে,
কারণ তারা শুনেছে—
মেয়েরা এবার নিজের পছন্দে বর বেছে নিচ্ছে!
সভাপতি মনুমশাই নিজের বায়োডাটা প্রিন্ট করে এনেছেন—
“৪৭ বছর, স্থায়ী চাকরি, বেতন ভালো, মতাদর্শ— মনুবাদে বিশ্বাসী।”
তিনি আত্মবিশ্বাসে ভরা মুখে কাউন্টারে গিয়ে বসলেন।
রিসেপশনিস্ট— এক তরুণী, নাম তন্বী।
তন্বী ফর্ম দেখেই বলল,
“স্যার, ‘মনুবাদে বিশ্বাসী’ মানে কী?”
মনুমশাই গর্বে বললেন,
“মানে, আমি সেই দর্শনে বিশ্বাসী, যেখানে নারী স্বামীর সেবা করেই মোক্ষ লাভ করে।”
তন্বী চুপ করে কম্পিউটারে কিছু টাইপ করল।
মনুমশাই জিজ্ঞেস করলেন, “আমার ম্যাচ পাওয়া গেছে?”
তন্বী বলল,
“হ্যাঁ, পেয়েছি— কিন্তু সব প্রোফাইলেই লেখা আছে, ‘মনুবাদী প্রার্থী আবেদন করবেন না।’”
মনুমশাই স্তব্ধ।
পেছনে অন্য সদস্যদের দিকে তাকালেন— তারাও হতাশ মুখে।
একজন বলল,
“আমার বায়োডাটায় লিখেছিলাম— ‘মেয়েকে কাজ করতে দিতে পারব না।’
ওরা রিপ্লাই দিয়েছে— ‘তবে নিজেই রাঁধুনি নিয়োগ করতে পারেন।’”
আরেকজন বলল,
“আমার প্রস্তাবে লেখা ছিল— ‘স্ত্রী যেন বিনয়ী হয়।’
উত্তরে পেলাম— ‘বিনয় এখন ক্লাস সেভেনের পাঠ্যবইয়ে, মানুষের গুণ নয়।’”
মনুর দল হাঁপ ছেড়ে বসে পড়ল।
ঠিক তখনই পাশের টেবিলে বসে থাকা এক তরুণী বলল,
“স্যার, এখন মেয়েরা শুধু বর খোঁজে না—
খোঁজে সঙ্গী, সমান অংশীদার। যে পুরুষ মনে করে নারী তার ছায়া, সে এখন আলো পেতেই অন্ধ হয়ে যায়।”
মনুমশাই হতবাক।
বললেন,
“তাহলে কি আমাদের যুগ শেষ?”
তরুণী মৃদু হেসে বলল,
“না, স্যার। যুগ শেষ হয়নি। শুধু মেয়েরা এবার বিয়ের পাত্র নয়— নিজের জীবনসঙ্গী বেছে নিচ্ছে।”
মনুর দল বেরিয়ে এল মাথা নিচু করে।
বাইরে ব্যানারে লেখা—
“নতুন বিবাহনীতি: পাত্র যদি নারীকে মান্য না করে, পাত্রের বায়োডাটা বাতিল।”
সভাপতি বিড়বিড় করে বললেন,
“মনু যদি আজ থাকতেন, উনি বলতেন— ‘যে নারীকে বশ করতে পারলে সমাজ টিকে যাবে।’ কিন্তু আজ দেখি, যে নারীকে বোঝা গেল না, তিনিই সমাজকে বাঁচাচ্ছেন।”
পেছনে কেউ মৃদু গলায় গেয়ে উঠল—
“এই মনুর দল এখন ‘সিঙ্গল বাট সচেতন’। বাঁধন ভাঙে, আবার মন খুলেও বাঁচে নারী।”
সংস্কার একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। রাজনীতি, ধর্মনীতি কিংবা সামাজিক নীতিতে সময়পোযোগী পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়ে পরে তখন সেইমতো সংশোধনের প্রক্রিয়াকে মান্যতা দিতে হয় কিন্তু প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাকে চারণ করবার ভিত্তি থাকে না, তখন কার্যত তার মৃত্যু ঘটে গেছে, যাকে আমরা এক্সপায়ার প্রোডাক্ট বলে থাকি। তখন সমাজে, রাজনীতিতে কিংবা ধর্মনীতিতে সেটি অচল বলে গণ্য করা হয়। আর সেই মৃত নিয়মকে একদল মানুষ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যখন সাধারণ মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে চায়, তখন সে হয় কুসংস্কার। যেমন, আমরা মহাভারতে দেখি রাজবংশ রক্ষা করার জন্য সমাজে 'নিয়োগ প্রথা'র চল ছিল যার ফলে বেদব্যাসের দ্বারা অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র ও পান্ডুর জন্ম হয়। সেই প্রথা আজকের দিনে অচল। এরকম বহু নিয়ম আজ অতীতের গহ্বরে চলে গেছে তার অজস্র উদাহরণ আছে।
তাই বেঁচে থাক মনুবাদ অবশ্যিই ইতিহাসের পাতায়, যে আয়নায় মানুষ অতীতকে পর্যবেক্ষন আর পৰ্য্যালোচনা করবে আর বলবে- " ভারতবর্ষে এমন এক অন্ধকারের যুগ ছিল"। পৃথিবীর মানচিত্রে খুঁজবে এমনিই এক মনুর উদাহরণ। যখন মানুষের জ্ঞানের পাল্লাটা ভারী হবে আর মনুর গোডাউন ততই খালি হবে। এও এক ইতিহাসের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। নতুনকে ছেড়ে দিতে হবে তার স্থান।
ব্লগার- রবীন মজুমদার
তারিখ -০৫/১১/২৫
ভালো লাগলে শেয়ার করুণ -
rabinujaan.blogspot.com থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
মন্তব্যসমূহ