(২৫৪) ফ্যাসিজমের রুট কজ
ডাক্তার যেমন তার জানার নির্দ্দিষ্ট পরিধির মধ্যে রোগীর রোগের কারণ নির্ণয় করার পরে চিকিৎসা শুরু করেন, ঠিক তেমনি আমাদের বিশ্লেষণ করার যোগ্যতা নির্ধারণ হবে অবশ্যিই আমাদের সীমিত জানার মাপকাঠিতে।
সাধারণজ্ঞান বলে জন্মলগ্ন থেকে মানুষের মধ্যে ফ্যাসিজমের রক্ত কখনই প্রভাবিত হয় না। তা যদি না হয় তবে এর প্রাদুর্ভাবের কারণ অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা আছে। কারণ ছাড়া কোন কার্য্য যেমন হয় না কিন্তু এটাও বলা নেই এই কারণকে খুঁজতে কতদূর পর্যন্ত যেতে হবে তার কি কোন নিদ্দিষ্ট সীমারেখা বোধহয় আছে। কাজটা ভীষণ কঠিন কিন্তু কঠিন পণ করলে উত্তরকে সামনে নিয়ে আসা যায়।
আমাদের লক্ষ্য পূর্ব নির্ধারিত অর্থাৎ কিভাবে একটি মানুষ ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠে তার পশ্চাদপদকে চিহ্নিত করা। বাস্তবে সেই মানুষটি ভীষণ কষ্টে আছে, কেননা সে ভীষণ তৃষিত কিন্তু হালে পানি পাচ্ছেনা আর সেই কারণে সে ক্রমেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। মজার ব্যাপার হলো, এদের তৃষ্ণা উত্তরোত্তর এতই বৃদ্ধি পায় আর সেই তৃষ্ণা কোনদিনই পূর্ণতা লাভ করেনা, এটা প্রমাণিত।
নিজ নিজ কাজে যখন সকলে ব্যস্ত, তখন সে সারা দিন ধরে নিজের অভীষ্ট পূরণের জন্য মানুষের মধ্যে বিভাজনের বীজ বপনে তিনি মত্ত। এই বাসনা অসুস্থতার প্রাথমিক কারণ। দেশবাসীর সামাজিক দায়িত্ব এই অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তাকে পুনর্বাসন দেওয়া।
বিশ্লেষণ করবার বহু পদ্ধতি আছে, সঠিক ফলাফল দেবার ক্ষেত্রে তার মধ্যে কোন পদ্ধতি ইতিমধ্যে বিশেষ কৃতকার্যতার প্রমান দিয়েছে, তার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। এইসব মানুষের জীবনদর্শন প্রমান করে যে তাঁরা জীবনবোধের দর্শনের অদর্শনে পীড়িত।
বোধবুদ্ধির রকমফের আছে। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব স্ফুরণে এই বোধের ভীষণ ভূমিকা আছে। এই বোধের আবার দুটি দিক আছে একটি উচ্চগামী এবং অন্যটি নিম্নগামী। নিম্নগামী বা ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্ববোধের কারণে মানুষ নির্বোধের মতো আচরণ করে থাকে। নিম্নগামী বোধের উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্ববোধ, যার প্রতিক্রিয়া হিসাবে একজন ফ্যাসিবাদী আদর্শের অনুসরণকারী অপর মানুষের সাথে নিজেকে আলাদা ভাবে। এই ভাবনাটির পিছনে রয়েছে তার ইন্দ্রিয় নির্ভরতা। মানুষের মনের মধ্যে যেমন ত্যাগের আদর্শ বাস করে, ঠিক তেমনি তার বিপরীত মেরুর ভাবনাগুলিও একই সাথে বাস করে, যেমন ভোগ,কামনা এবং বাসনা। যে সর্বদা নিজেকে অন্যদের থেকে সেরা ভেবে থাকে সে অহংকারী, আর যে ব্যক্তি অহংকারী সে কখনই ত্যাগ করতে জানেনা। তাহলে মনের মধ্যে বাকি যেটা পরে থাকে অর্থাৎ কামনা,বাসনা আর ভোগ তাদের পিয়াসী হতে বাধ্য। এই পাবার লোভ থেকেই হৃদয় পিপাসিত হয়।
এক অপ্রতিরোধ্য আবেগ শিরা-উপশিরায় আলোড়ন তৈরি করে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশ থেকে বলতে চাইছে, "হে মনুষ্য তুমি সবার থেকে পৃথক এক জীব, তোমার গুণমান যে কোন প্রাণী থেকে উৎকৃষ্ট,আর তোমার চারপাশের জীবেরা একান্তই নিকৃষ্টমানের, সুতরাং এই সমাজে তুমিই কর্ণধার হবার সুযোগ্য প্রার্থী"। এখন প্রশ্ন হলো তোমার যোগ্যতা কি প্রমাণিত ? উত্তর প্রমান হয়নি। তাহলে কে তোমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছে ? উত্তর আসবে অহংকার।
বস্তুজগতে বস্তুধর্মানুসারে দুইভাগে বিভক্ত। একটি সসীম অপরটি অসীম। এই অহংকার সমীমবস্তুর অন্তর্গত, কেননা সে জন্মগ্রহন করেছে আর যে বস্তু জন্মায় তার লয় অবধারিত। কিন্তু কেন সে প্রকাশমান হলো তার কারণকে অবশ্যিই জানতে হবে। সেই কাজের অনুসন্ধানের দায়িত্ব দর্শনের উপর।
ইতিমধ্যে আমরা আভাস পেয়ে গেছি ফ্যাসিস্টদের সাথে সাধারণ মানুষের গুনগত পার্থক্য হল চৈতন্যের। যার অভাবজনিত কারণে মানুষ মানুষের সাথে অমানবিক ব্যবহার করে। আমরা কোন আত্মকেন্দ্রিক মানুষকে যেমন অবিহিত করে থাকি 'আত্মাটা কি ছোট' এই বলে।
দর্শন যখন কোন প্রকাশনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে, তখন তার ইতিবৃত্তকে খোঁজার চেষ্টা করে। প্রথমে অহংকারের জন্মবৃত্তান্ত খুঁজতে গিয়ে ভারতীয় প্রাচীন দর্শন সাংখ্যর ব্যাখ্যা আকৃষ্ট করলো। এই দর্শনের আলোকে জানা যায়, প্রকৃতি জড় সম্প্রদায়ভুক্ত। তার পিছনে অবশ্য যথেষ্ট উদাহরণ তাঁরা দিয়েছেন। সত্ত্ব, রজ ও তম এই ত্রিগুণের সমাহারে এই প্রকৃতি। সৃষ্টির পূর্বে তারা সকলেই সমান ছিল। তারপর সৃষ্টির প্রক্রিয়া যখন শুরু হলো তখন তারা পূর্বের অব্যক্ত অবস্থা থেকে ব্যক্ত হল, ব্যস তাদের সেই পরাধীনতার শিকল ছিড়ে স্বাধীনভাবে নিজেদের প্রকাশ করলো। কোথাও রজ গুণের কতৃত্ব আবার কোথাও তম অর্থাৎ তামসিক গুনের কতৃত্ব পরিলক্ষিত হল। কে বলেছে তুমি আর আমি আলাদা, এই ভাবনা থেকে যে অসাম্য অবস্থার জন্ম হলো, সেটাই অহংকার নামে পরিচিত।
সাংখ্য দর্শন আত্মা বা চেতনাকে সম্বোধন করেছে'পুরুষ'নামে। এই পুরুষ ও প্রকৃতির দুইয়ের মিলনেই সৃষ্টি। মন,বুদ্ধি ও অহংকার প্রকৃতিরই উপাদান। যেহেতু প্রকৃতি জড় সেজন্য এরাও জড় বস্তুর অন্তর্গত। গাছের পাতার কোনদিন হেলদোল হতো না যদিনা বাতাস বইতো। গাছ যেহেতু প্রকৃতির উপাদান তাই সে জড়র অধীন। মানুষের মনও জড়ের অধীন সে চেতনা ছাড়া অপ্রকাশিত।
ধরা যাক, একটা সামন্তরাল রেখার উপর চৈতন্য (সর্ব বৃহৎ গোলক),তারপরে অহংকার ( ছোট গোলক), সর্বশেষে বুদ্ধি ( ছোট গোলক) দাঁড়িয়ে আছে। চৈতন্যের আলো বুদ্ধির উপর ততখানিই পৌঁছাবে যতখানি অহংকারের গোলকটি ছোট হবে। কেননা অহংকারের ছায়াটা জ্ঞানকে উন্মোচিত করতে না দেবার কারণে বুদ্ধি আছন্ন থাকে অহংকারে। এই মিথ্যা আবরণটাই মায়া। মায়াকে বিশ্বের আসল কারণ বলা হয়। কেননা, এই দেহ,মন ও আত্মার প্রকৃত স্বরূপ না জানার নামই মায়া। তাই মায়া নাম আর রূপ দিয়ে পার্থিব উপাদানগুলিকে আসল কারণ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। তাই সবকিছুকে নাম রূপের আড়ালে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়। আসলে জীবাত্মার কোনো পৃথক অস্তিত্ব থাকতেই পারেনা, সবই মায়ার খেলা। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একটাই সত্ত্বা আছে। আমার একটা সত্ত্বা, তোমার আরেকটি সত্ত্বা থাকাটা অসম্ভব। যত রকমের অবৈজ্ঞানিক দ্বৈতজ্ঞানকে প্রচার করে বিভেদ সৃষ্টি করাই হচ্ছে ফ্যাসিজমের উদ্দেশ্য। প্রগতির অর্থ এগিয়ে যাওয়া, পিছিয়ে পড়া নয়।
পরবর্তী সংখ্যায় এই রোগের সম্ভাব্য প্রতিকার ।।
ক্রমশঃ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন