(২১২) জগাখিচুড়ি -দ্বিতীয় সংখ্যা
সখি ভালোলাগা কারে কয় -
এই বিশ্বে ভালোলাগার নির্দ্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা কি আছে, না সেটা একটি গতিশীল মানব মনের প্রক্রিয়া। ভালোলাগা যদি স্রোতহীন জলাশয়ে পড়ে আবদ্ধ হয়ে যেত তাহলে তার তো পঙ্কিল সমাধি হতো। কতকিছু যে অসমাপ্ত হয়ে থাকতো, তার ইয়ত্তা নেই। পারতো কি কবি নিত্য নতুন কাব্য রচনা করতে, তানপুরার তারের সাথে আঙুলের মেল বন্ধনে নিত্য নতুন সুরের জন্ম কোনদিন হতো না, একঘেয়ে উপন্যাস পড়তে পড়তে পাঠক ক্লান্ত হয়ে যেত। সর্বোপরি, আজকের যে প্রথম সারিতে অলংকৃত করে বসে আছে যেই ভালোলাগার বস্তু একদিন সে সময়ের ডাকে অস্থাবর সম্পত্তিতে পরিণত হয়ে যাবে , তা কেউ বলতে পারেনা। সেই স্থলে অভিষিক্ত হবে নতুন এক ভালোলাগার বস্তু। এইভাবে বিশ্ব প্রকৃতি তার পরিবর্তনের জয়গান সবার অলক্ষে গেয়ে যাবে।
যেদিন আকাশ ভরে মেঘের আনাগোনা হয়, কবির মনটা চঞ্চল হয়ে উঠতে শুরু করে, কেননা, রোদের কষ্ট কেউ বোঝেনা; সারাদিন ধরে একটানা পরিবেশন করতে করতে সেও ক্লান্ত আর মর্ত্যের মানুষরা তো সবসময়ে বৈচিত্রের প্রত্যাশী। এমনিই এক সময়ে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি এলো, কবি প্রাণ ভোরে তার ভালোলাগার বৃষ্টিকে ক্ষনিকের জেনেও তার অনভূতি এতটুকু কার্পণ্য করে নি তাকে মন প্রাণ দিয়ে অনুভব করতে। তাহলে, তো ভালোলাগা আপেক্ষিক তত্ত্বের উপর নির্ভরশীল অর্থাৎ একাধিক কারণের সাথে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হবার কারণে একটা অস্থায়ী অনুভূতি বলা যেতে পারে।
**************************
ভালোলাগা কি অনুভূতির প্রতি বন্ধন না দাসত্ব -
আমাদের পাড়ার কালু। এই নামেই সবাই ঐ শ্রীহীন সারমেয়টিকে সম্বোধন করে থাকে। তাঁর যে কাউকে প্রভুত্ব প্রদান করার অদ্ভুত ক্ষমতা বিনিময়ে শুধু এক টুকরো বিস্কুটের অংশ কিংবা নিদেন পক্ষে একটু স্বীকৃতি। জানিনা, কোন এক অজ্ঞাত কারণে তার গায়ের লোমের আবরণটা কেড়ে নিয়ে তার সৌন্দর্যকে হরণ করে রিক্ত করে দিয়েছে, কিন্তু তার সহজাত প্রবৃত্তিকে সময় কাড়তে পারেনি , তাই সে রূপহীন লাবন্যকে পরিপূর্ন করেছে তার সাথে বেড়ে ওঠা সহপ্রাণীদের প্রতি সহমর্মিতায়। তার এক সচতুর অনুমানের কথা না বললে কালুর কাহিনীটি অসমাপ্ত থেকে যাবে।
এই পথ কত প্রাণীকে জীবনধারণ করতে শেখায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের মতি নামে নামগোত্রহীন বালক, যার তিনকূলে কেউ নেই। যার নেশা আর পেশাই হচ্ছে ফেলে দেওয়া আশেপাশের বাড়ির আবর্জনা থেকে সঠিক বস্তুকে অনুসন্ধান করে তাকে বাজারজাত করা। সেটা তার নিত্য দিনের কাজ। তার সাথে কালুকে পর্ভারিশ করাকে তার দৈনিন্দন রুটিনের মধ্যে ঠিক কবে থেকে অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেছিল, সেটা নিজেই জানেনা। রাতবিরাতে বাড়ির সিঁড়ির তলায় আর দিনের বেলা কোন ছায়ায় দিনগুজরান তাদের হয়ে যেত। মতি আবার সুন্দর গান গাইতে পারতো আর তার নিয়মিত মনোমুদ্ধ শ্রোতা ছিল কালু। কালুর অদ্ভুত সুন্দর চোখ আপনভোলা মতির মুখের উপর নিবদ্ধ করে একাগ্র চিত্তে সেই সুর উপভোগ করতো। আবার তাদের মধ্যে চোখে চোখে অনেক কথা যে হতনা, সেটা জোর করে বলা যায় না। মতি কি যে ভাষা বুঝতে পেরেছিলো জানিনা। মতির সাথে হারুকাকার ভীষণ আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। একদিন পাড়ার হারু কাকাকে বলতে শুনেছি, যে, কালু একদিন খুব সুন্দর দেখতে ছিল, সুন্দর লোমে আবৃত ছিল তার বহিরমন্ডল ,পাড়ার সবাই তাকে আদর করতো, সামনের বাড়ির অনিকবাবুর ছোট্ট ছেলে সুমন তাকে পোষ্য করার জন্য বেশ কয়েকদিন ধরে নিয়মিত বায়না করে আসছিলো। তাদের পরিবার কোন অবস্থায় সেটা মেনে নেয়নি। একদিন সুমন তার মা'র সাথে কল্যাণীতে তার মামার বাড়ি থেকে গরমের এক মাসের ছুটি কাটিয়ে এসে দেখে সেই কালু তার জৌলস হারিয়ে ফেলেছে কিন্তু তার উজ্জ্বল চোখদুটি অম্লান। সুমনের সাথে চোখে চোখে যেন অনেক কথা হল। সুমন বুঝতে পারলো বোধহয় তার অন্ধ ভালোবাসা এ যাত্রায় কালুর প্রানটা নেয়নি কিন্তু তাকে রূপহীন করার পিছনে তার বাড়ির মানুষদের বিশেষ অবদান আছে। সহমর্মিতার কথা বলেছিলাম, এই বিশেষণের যোগ্য উদাহরণ কালু তার জীবন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সেদিন সকালে আপনমনে গান গাইতে গাইতে মতি পিঠের ঝোলাটা নিয়ে রাস্তাটা পারাপার করছিলো। খানিক দূরে থাকা দ্রুত গতিতে ছুটে আসা গাড়িটাকে লক্ষ্য করে কালু তীব্র গতিতে ছুঁটে গিয়ে মতিকে পিছন থেকে তার ক্ষুদ্র শরীরে সব ইচ্ছা শক্তিকে এক করে প্রায় একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে সম্ভাব্য বিপদ থেকে রক্ষা করলো বটে কিন্তু সেখানে নিজেকে অরক্ষিত রাখার জন্য সেই পথেই সে চিরকালের মতো হারিয়ে গেলো ।
এও একধরনের ভালো লাগা, যেখানে জাগ্রত হয় কর্তব্যবোধ, সেখানে সেই ভালোলাগার প্রতি আনুগত্যতা পার্থিব জীবনের মানে খুঁজতে যায়না। সেই ভালোলাগার বীজ যখন অন্তরের গভীরে প্রোথিত হয়ে ভালোবাসা হয়ে যায় অর্থাৎ অপর বস্তুর উপর কোন প্রাণী নিজের আত্মার প্রতিবিম্ব দেখতে পায়, তখন সেই অনুভূতি দেশ, কাল, সময়কে অতিক্রম করে অনন্তের সাথে একাত্ম হয়ে যায়। এই ভালোলাগার ব্যাপারে বিশ্লেষণ করলে তার পিছনে নির্দিষ্ট কোন কারণ হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে না, কেননা সেটি বহুবিধ কারণে সমষ্টি।
*****************************
ব্লগার -রবীন মজুমদার
তারিখ -০৯/০৬/২৪ ভোর ৫:০৪
https://rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন