(২১৪) মহাকাব্যের গহন হৃদয় মাঝে যে গান এখনো বাজে
রামায়ণ ও মহাভারত উভয়ের জন্ম যখন সেই মহাকাব্যের বংশ থেকে তখন জনমানসে একটা তুলনা করার প্রবণতা বিদ্যমান। নিঃসন্দেহ এই বিতর্ক প্রমান করে যে কোন সাহিত্যের সারাৎসারকে, যা আজও সমাজে বহুল চর্চিত। 'বিশেষণ' নামক বিষয়টি খুব যে সহজ পাচ্য, সেটা জোর করে বলা যায় না। সেই আপাত কঠিন বিশেষণকে ব্যাকরণের পাতা থেকে খসিয়ে নিয়ে বাক্যের গূঢ় ব্যাখ্যায় অতীব সহজ সরল পাচ্য করার ক্ষেত্রে রামায়ণ ও মহাভারতের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। এখানেই তাঁরা অমরত্বের অবিসংবাদিত দাবিদার শুধু নয়, সেখানে তাঁরা প্রতিষ্ঠিত। একটু উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। যেমন, কুটিল শব্দকে মনের অন্দরে চিরস্থায়ী রোপনের জন্য ' শকুনির মতো' বললেই আর কিছু ব্যাখ্যা করার দরকার নেই। সত্যবাদীর দৃষ্টান্ত যেমন যুধিষ্ঠির, শক্তিমানকে সংজ্ঞায়িত করতে গেলে শুধু 'ভীম' নামটি উচ্চারণ করলেই চলবে , পিতার প্রতি আনুগত্যের নিদর্শন শুধু 'রাম' নামটি মুখে আনলেই হয়ে যাবে আর যদি বিশ্বাসঘাতক শব্দটির সাথে 'বিভীষণ ' নামটি ভীষণ সমার্থক ও সাংঘাতিক ভাবে প্রচলিত। এরকম অজস্ত্র উদাহরণ আজও সমাদৃত , যাঁরা রামায়ণ ও মহাভারতের পাতায় জন্ম গ্রহণ করেছিল।
বহু তথকথিত ইন্টেলেক্চুয়াল মানুষরা বলে থাকেন, অলৌকিকতাই অসম্ভবভাবে প্রাধান্য পেয়েছে এই সব মহাকাব্যগুলিতে। এর উত্তরে বলা যায়, অলৌকিকতা , অতিরঞ্জন এই সবই চকলেটের বাহ্যিক মোড়ক আসল স্বাদতো তার ভিতরে ঢুকলে বোঝা যাবে। মোড়ক না থাকলে জন্মলগ্ন থেকে ভারতীয় শিশুরা মা-ঠাকুমা বা দিদার কোলে শুয়ে-বসে পরম উৎসাহে বারবার কি জিজ্ঞাসা করতো , "দিদা তারপরে কি হলো ?" , সেই সব ছোট বড় অনুসন্ধিৎসা নিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তো, কেউ জানেনা। সেই সব শিশুদের স্বপ্নে হনূমান, রাক্ষসেরা যেমন আসতো, তার সাথে ছোট ছোট আকর্ষণীয় গল্পের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আপাত নিরীহ তত্ত্ব কথার যে আনাগোনা হতোনা, সেটা জোর করে, বলা যায় না। এখানেই বাল্মীকি আর বেদব্যাস ও অসংখ্য ঋষিদের অবদান। এই পুরুষার্থের বীজ বপনই ছিল এই কাব্যগ্রন্থের উদ্দেশ্য।
হিন্দুদের প্রচলিত কোনো ধর্ম গ্রন্থ কোন কালেই ছিল না। বেদ কোন ধর্ম গ্রন্থ নয়, আসলে মানুষ যখন গভীর সংকট থেকে মুক্তি পেতে যার আশ্রয় নিয়ে থাকে সেই গ্রন্থই হচ্ছে মানুষের পথ নির্দেশক, সেই কাজটি রামায়ণ ও মহাভারত যথযথভাবে পালন করে আসছে, তাই সেটাই হিন্দুদের ধর্ম গ্রন্থ। তুমি মানুষ হিসাবে পৃথিবীতে এসেছো, খাও দাও ভোগ করো, ভোগকে পূরণ করার জন্য কাজ করে সৎ পথে অর্থ উপার্জ্জন কর , অবশেষে সংসারধর্ম পালনের ইতি টেনে জীবন থেকে অবসর নিয়ে আত্ম অনুসন্ধানে ব্রতী হও, সেটাই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য, সেটাই মোক্ষ। ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই পুরুষার্থঃই হচ্ছে ব্যক্তি জীবনের ধর্ম পালন।
ভারতীয় দর্শনে কার্য্য কারণকে কেন্দ্র করে বস্তুর বহুগামিতার যথার্থ উদাহরণ রামায়ণে দেখা যায়। বস্তুর তিন রকমের গুণ তার অস্তিত্বের মধ্যে নিহিত থাকে। তার উদাহরণ সীতা। রামের কাছে সীতা যথার্থ সুখের অনুভূতি। রামের কামনার পিয়াসী শূর্পণখার কাছে সীতা অবশ্যিই দুঃখের কারণ এবং সীতার সঙ্গ পাবার কামনায় কাতর রাবনের কাছে তিনি মোহের কারণ। এরকম অসংখ্য ঘটনা রামায়ণ ও মহাভারতের সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে আছে।
তারিখ - ১১/০৬/২৪ ভোর - ৪:৫৩
https://rabinujaan.blogspot.com
ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন