(২১৬) মহাকাব্যের সমুদ্র মন্থন
সত্যের পথটা যেন সব সময় দুর্গম কি রামায়ণে অথবা মহাভারতে। তাই এই পথে যাত্রী সংখ্যা একান্তই কম। জীবনের প্রাইম টাইমটা তাঁদের গোটা পরিবারটিকে নিয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়ে তাঁরা কাটিয়ে দিয়েছে। যোগ্যতা ছিল রাজসিক আরাম ভোগ করার, উপাদেয় খাদ্যপানীয় দিয়ে দেহ মন ভরিয়ে দেবার , আরো কত ঐশো আরামে নিজেদের ভাসিয়ে দেবার কিন্তু কিছুই গ্রহণ করলো না। অনেকটা আজকের দিনের সাবেকী কমিউনিস্টদের মতো। সারা বিশ্বে তাদের অস্তিত্ব আছে, সংখ্যায় তাঁরা নগণ্য, খুব কম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় তাঁদের প্রতিনিধিত্ব আছে। আবার কেউবা রাজসিংহাসনের আসে পাশে থেকে নিজেকে সর্বকালের ব্র্যান্ড হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার আকর্ষণ ত্যাগ করতে পারেননি। যাঁকে সারা ভারতবর্ষ "প্রতিজ্ঞা" নামটা উচ্চারণের সাথে সাথে ভীষ্মকে শব্দের সমার্থক করে দিয়েছেন।
রাম এবং ভীষ্ম এই দুজনেই আসলে তাঁদের পিতাদের দ্বারা একধরনের প্রতারিত হয়েছিলেন। রাজা দশরথ এবং শান্তনু উভয়েই উগ্র যৌন কামনার বশবর্তী হয়ে সন্তানদের আবেগকে নিয়ে জঘন্যভাবে খেলা করেছিলেন। দেবব্রত তো জীবনে দাম্পত্য জীবনের সুখ থেকে যেমন বঞ্চিত হয়েছিলেন, সেখানে সাধারণভাবে সংসারের সান্নিধ্য থেকে তাঁর দূরে থাকাটাই কাম্য ছিল। কিন্তু তার পরিবর্তে অধিকার থেকে স্বেচ্ছায় বঞ্চিত কিন্তু দায়িত্বের বেড়াজালে নিজ প্রতিশ্রুতিতে আজীবন পুঁতি গন্ধময় সংসারে আবদ্ধ, বৈচিত্রের অভিধানে এক বিরল প্রজাতি। অন্যদিকে, যেখানে কামনা-বাসনা সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে সেইতো দেবজ্ঞানে পূজিত হয়। ফাঁদ পাতার কাজটি প্রলোভন যথার্থভাবে করে থাকেন আর অর্থ ও ক্ষমতা সেখানে সেই ভোগ দেবতার কাছে পৌঁছানোর সেতু বন্ধন করার কাজটি করে থাকেন।
এই সংসারে সব কিছু লাভ করার পরিবর্তে বিনিময়মূল্যও গুনতে হয়। রাজা দশরথকে রানীর কাছ থেকে সোহাগ ভিক্ষার পরিবর্তে অঙ্গীকারকেই মূল্যজ্ঞানে মিটাতে হয়েছিল। জৈষ্ঠ্য পুত্রের প্রথাগত রাজ্য অভিষেক এবং রাজসভা থেকে নির্দ্দিষ্ট সময়ের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে অরণ্যের পাঠ গ্রহণ করাকে রাজা অবলীলায় মেনে নিয়েছিলেন। প্রশ্ন থেকেই যায়, যে সব পিতা নিজ সন্তানদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে পদদলিত করে নিজেদেরকে সংযমে আবদ্ধ রাখতে পারেন না, তাঁরা, তার সন্তানসম প্রজাদের অধিকার প্রতিষ্ঠাকে কি করে মান্যতা দিতেন ? কামনা নামক ভুতটির এমনিই মাহাত্ম যে এক নিমেষে ন্যায়-অন্যায়কে ঘাড় মটকে খেয়ে নিতে পারে এবং সামান্য কিছু ব্যাতিক্রমী ছাড়া সেটাই সে করে থাকে।
এই বিশ্ব প্রকৃতির জন্মের পশ্চাতের দ্বন্দ্বটা যে শাশ্বত, তার প্রতিফলন রামায়ন-মহাভারতের প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গে সেই শোভা প্রস্ফুটিত। কখন সে পরিবারের অন্দরমহলে, রাজসভায় আবার চারদেয়ালের গন্ডিকে অতিক্রম করে প্রশস্ত মাঠে-ময়দানে। একবারে প্রদর্শনীর মতো। সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে জাতি,ধর্ম, বর্ণের কোন ভেদাভেদ কোন কালেই ছিলো না, কেননা এটা জীবন বিসর্জনের জায়গা, প্রতিষ্ঠানের কাছে কোন পাওনার জায়গা নয়। যেন বিশ্ব মানবের রঙ্গমঞ্চ। সবাই নিজের মুখস্ত করা পাঠ মঞ্চে করে যাচ্ছেন। একজন তার নির্দ্দিষ্ট কারিশমা দেখানোর পর চিরতরে রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নিচ্ছেন। এই অভিনয়ের উদ্দেশ্য, কেউবা জানেন আবার কেউবা না জেনেই অংশগ্রহণ করেছেন। কাহিনীর স্রষ্টাই শুধু জানেন। যখন যুদ্ধ সংগঠিত হয় তখন কোনো সাইনবোর্ডে লেখা থাকেনা, এই প্রান্তরে ধর্ম অথবা অধর্ম যুদ্ধ সংগঠিত হচ্ছে । ঘটনা ঘটে যাবার পর, ধ্বংসস্তুপের মধ্যে থেকে নমুনা সংগ্রহ করে রাসায়নাগারে দীর্ঘ সময়ধরে ঐতিহাসিক, নৃতত্ববিদ, পুরোতত্ববিদ ও সমাজ বিজ্ঞানীদের যৌথ প্রযোজনায় গবেষণা করে যুদ্ধের চরিত্র নির্ধারণ করা হয়। এক চুলচেরা বিশ্লেষণ। সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো। সমুদ্র মন্থন না হলে অমৃত কি বেরোতো ? অনন্তকাল ধরে এই প্রশ্ন চলতেই থাকবে।
ব্লগার -রবীন মজুমদার
তারিখ ১৩/০৬/২৪ ভোর ৪:২১ মিঃ
https://rabinujaan.blogspot.com
ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন