(২২১) একটি বিশ্বাসের অপমৃত্যু
ভারতবর্ষ কি এখনো রামায়ন ও মহাভারতময় (সপ্তম পর্ব)
একটা প্রতিশ্রুতি পালন করতে গিয়ে কালঘাম ছুটে যায়। আর সেই রামায়ণ কিনা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খালি অঙ্গীকারের বন্যা বইয়ে দিয়েছে। তার খেসারত দিতে গিয়ে মুষ্টিমেয় কজন আহার নিদ্রা আর পার্থিব সুখকে ত্যাগ করে ছুটে মরেছে। এক প্রতিশ্রুতিতে পুত্রের বনে গমন, আবার সেই পুত্রের আরেক প্রতিশ্রুতিতে লঙ্কায় গিয়ে ওয়ার ট্যুরিজম করে স্ত্রী চুরির দায়ে রাবনের প্রাণ হরণে কাহিনীর নিষ্পত্তি।
কি দরকার ছিল রামের সোনার হরিণ ধরে আনার প্রতিশ্রুতি দেবার , বিদগ্ধ মহলে প্রশ্ন উঠছে হরিণ আবার সোনার হয় কি করে ? এখানে রামের সীতার প্রতি অন্ধ বিশ্বাসের কারণে রক্ত মাংসের হরিণ ব্যতিরেকে বিধাতা যে কোন দিন স্বর্ণ নির্মিত হরিণকে যে বাপের জন্মে তৈরি করেন নি, সেটা কি জানা ছিল না ! আবার সেই রামই লঙ্কা ফেরত সীতার সতীত্বের প্রশ্নে অবিশ্বাস করে অগ্নিকে দিয়ে স্ক্যান করালেন।
অনন্ত কাল ধরে সেই একটাই প্রশ্ন থেকেই যাবে, যে রামায়ণ কে মহাকাব্যে নাম দিয়ে ভূষিত করলো। যার আপাদমস্তক একগাদা অলৌকিক ঘটনা দিয়ে ঠাসা আবার রূপকথার ক্যাপসুলের আচ্ছাদনে ঢাকা।
শ্রোতার ধৈর্য্যের বিনিময়ে সেই রহস্য উৎঘাটিত হতে পারে । যে রামায়ণ-মহাভারত সমগ্র ভারতবাসী শৈশব থেকে বৃদ্ধাবস্থা পর্যন্ত অধীর আগ্রহে শুনে এসেছে, তাকে যদি জিজ্ঞাসা করো কালকে কি দিয়ে ভাত খেয়েছে, সেটা হয়তো বলতে পারবেনা কিন্তু এইসব মহাকাব্যের যে কোন অংশ থেকে প্রশ্ন করো, তার সঠিক উত্তর তারা দিয়ে দেবে।
যে কথার মধ্যে গভীর সৌন্দর্যবোধ , চিত্তাকর্ষক গন্ধ , মনভোলানো স্বাদ আর অবশেষে গ্রহণ করার পর অশেষ তৃপ্তি আছে- সেটাই তো রূপকথা। তার আড়ালে আত্মগোপন করে থাকে অনেক অপ্রকাশিত রসকষহীন শব্দ তাকে মূল্যবোধের মোলায়েম গল্প দিয়ে রন্ধন করে , সুখানুভূতির প্রলেপ দিয়ে, জীবনবোধের সুস্বাদু মশলা দিয়ে পরিবেশন করলে যে আজীবন সেই স্বাদ মানুষ যে ভুলতে পারেনা, সেটাই এক মহাকাব্য রচনার অনন্য কৃতিত্ব।
অবিশ্বাস্য ছবিগুলিকে শুধু মাত্র তুলি আর রঙের সুষম ব্যবহারে একটা শিল্পী কেমন করে ক্যানভাসের পাতায় জীবন্ত করে তোলে আর সেই ছবি যেন পর্দা থেকে নেমে এসে যেন আমাদের সাথে কথা বলে। তবে বুলিরও সেই ক্ষমতা থাকবেনা কেন ? আর বুলির মধ্যে যদি সেই দম থাকে তবে কবির মনের যত ইচ্ছাকে তোমার মধ্যে পূরণ করবার জন্য সেতু বাধার কাজটা রূপকথা দিয়ে সেরে ফেলাই ছিল সেদিনের মূল কাহিনীর প্রধান ইউ.এস.পি.। তাতে করে বড় বড় ড্যাবড্যাবে চোখ মেলে আর কানগুলিকে খাড়া করে যে কথাকে গিলে খাওয়া যায় আর তার অন্তোষ্টি ক্রিয়ার প্রতিচ্ছবিটি জ্বলজ্বল করে মনের আয়নায় জীবন্ত প্রদর্শনীর আয়োজন করে , সেই মহাকাব্যকে গলাধঃকরণ না করলে বিশ্বাসই হতোনা। এই বিবিধ বিষয়কে একটা চালচিত্রে তুলে ধরার পিছনে কতনা পরিকল্পনা ছিল , সেযুগের কবি, সাহিত্যিকদের, তাকে যদি রাসায়নাগারে না ঢোকাতে পারতুম, তা না হলে বোঝাই যেতো না।
কটু স্বাদকে আড়াল করার জন্য মধুর ব্যবহার ঔষধিকে গলাধঃকরণের ক্ষেত্রে বহুল প্রচলিত ছিল। মানুষের সমস্যাময় জীবন, জঙ্গলের শ্বাপদ সংকুল অবস্থার থেকেও আরও জটিল, সেখানে জীবনবোধ, মূল্যবোধকে জায়গা দেবার মতো মানসিক পরিমন্ডল তৈরিই হয়নি, সেখানে এই জ্ঞান প্রবেশের দ্বার ছিল রুদ্ধ। রুদ্ধ দ্বারে কড়া নাড়ার ক্ষমতা একমাত্র সেই হালকা চালে হেঁটে বেড়ানো রূপের অন্তরালে থাকা সেই অলৌকিক কথাগুলির যোগ্যতা ছিল। একেই সম্যসায় বিধস্ত, তাই সেই সমস্যার কথা পুনরায় না বলে, এমনভাবে উপস্থাপন কর , যাতে সেটাকে সমস্যা না ভেবে শ্রোতা যেন তাকে গল্প বলেই ভাবে। ইত্যাবসরে নিঃশব্দে কবিদের উদ্দেশ্যের নীরব সমাধানের মন্ত্র, শ্রোতার হৃদয়ে অনাবিল আনন্দ সহকারে প্রবেশ করিয়ে দাও। সেই গল্পে একই সাথে বাস করে জীবনের সমস্যার সমাধান আর তার পদ্ধতি ও সমস্যায় পড়ার কারণগুলি । ব্যাস কাজ শেষ। এবার দেখার পালা, সূত্র তো শিখালে , তারা কি পারছে সমস্যার সমাধান করতে ? পারছে কি ভালোমন্দের তফাৎ খুঁজতে ? ভাবতে কি তারা শিখেছে ? আর কি কি শিখলো ? এখন কি তারা গল্প বলতে শিখেছে ? এইসব বহু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সেদিনের ঋষি মুনিরা সমাজ-সংসারের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তাঁদের সৃষ্টির প্রতিধ্বনি শুনতে। সেই বিরামহীন ধারাবাহিকতা আজও সমাজে ধীরগতিতে বিদ্যমান। যখনিই ফাঁক তৈরি হচ্ছে , তখনিই লোভ, অর্থ ও কাম সেখান দিয়ে প্রবেশ করছে।
সমাজ-সংসার বোধ হয় কারাগার কিংবা চিড়িয়াখানা যেখানে ইন্দ্রিয়ের বাসনাকে কয়েদ করে রাখা হয় , কখন জোর করে আবার কখন বা অভ্যাস বশে। আবার সেখান থেকে মুক্ত করে দিলে সেই আদিম বৃত্তিগুলি সময়ে সময়ে জেগে উঠে।
এমনি এক সময়ে গভীর অরণ্যের সাদামাটা কুটিরে ভাগ্যবিড়ম্বনায় স্বামী ও দেবরের সাথে এক সুন্দরী রমণী বাস করতো। খাদ্যের অন্বেষনে যখন একজন পুরুষ কুটির থেকে বের হতেন , তখন সেই রমণীকে পাহারা দেবার জন্য একজন সঙ্গে থাকতেন। এইভাবেই দিনগুলি কেটে যাচ্ছিল। এই ঘটনা চর মারফত সাগর পাড়ের এক দুষ্ট রাজার কানে এলো। সেই রাজার আবার জঙ্গলের জীব-জন্তুদের সাথে সুন্দরী মহিলা শিকার করার অভ্যাসটি বরাবরের ছিল। প্রথমদিন দূর থেকে পর্যবেক্ষন করে তার রূপের উজ্জ্বল্য রাজার মনে মোহের সঞ্চার করলো। দুর্নিবার আকর্ষণের বশবর্তী হয়ে তিনি সেদিনের পাহারাদার দেবরকে কুটির থেকে বাইরের বের করার জন্য কৃত্তিম পরিবেশ তৈরি করলেন। গল্পের মাঝখানে একটা সোনার হরিনের উপস্থিতিতে সমগ্র কাহিনীকে একটা ভিন্নমুখে চালিত করলো। সীতা সেই সোনার হরিনের প্রতি এমনিই আকৃষ্ট হলো এবং তার সাথে চিরন্তন নারী সুলভ অবিবেচকদের মতো বায়না, ঘরের পুরুষদের ব্যাতিব্যাস্ত করে তুললো , অবশেষে রামও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সেই সোনার হরিণ ধরার মতো জ্ঞানগম্মিহীন কাজকে সাফল্যমন্ডিত করতে পশ্চাৎ ধাবন করলেন। কাহিনীতে এবার শুরু হলো উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্ত। তার পরবর্তী ঘটনা আমরা সবাই জানি।
পর পুরুষের সুন্দরী অরক্ষিত মহিলাকে ভোগ করার জন্য অপহরণ করতেই পারে, সেটা অন্যায় হলেও বাস্তব। কিন্তু সূত্রপাতটা সোনার হরিনের মতো একটা অসম্ভব বস্তুকে লাভ করার মতো বাসনা এবং তার সাথে প্রেমান্ধ পুরুষ রামের স্বাভাবিক বুদ্ধির লোপ তার প্রমান স্বরূপ, যে সোনার দ্বারা নির্মিত কোন হরিণ যে হতেই পারেনা। এই সত্যটাকে সীতার কাছে বলার মতো সৎ-সাহস ছিল না কিংবা তিনিও সীতার মতো বিশ্বাস করতেন সোনার হরিণ হতে পারে। এই বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলায় পরোক্ষ প্রভাবে কত মানুষের প্রাণের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হল অন্ধ বিশ্বাস প্রকারান্তরে বিপদ নিয়ে আসে কিন্তু বিচার বিশ্লেষণই একমাত্র বিশ্বাস যোগ্যতার মাপকাঠি হওয়া উচিত।
চলবে ০০০০০০
ব্লগার -রবীন মজুমদার
তারিখ - ২০/০৬/২৪ ভোর ৫:৩১ মিঃ
২টি মন্তব্য:
রূপকথা হিসাবে রামায়ণ মহাভারত চিত্তাকর্ষক। আমাদের সমাজে প্রেম ভালবাসা কূটনীতি কে ভিত্তি করে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। রামায়ণ মহাভারত দেখার পরিণাম হলো বাবরি মসজিদ ধ্বংস। আর রামেশ্বর সেতু বন্ধ হলো কিছু ভৌগোলিক সীমানা পরিবর্তন।
রূপকথা হিসাবে রামায়ণ মহাভারত চিত্তাকর্ষক। আমাদের সমাজে প্রেম ভালবাসা কূটনীতি কে ভিত্তি করে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। রামায়ণ মহাভারত দেখার পরিণাম হলো বাবরি মসজিদ ধ্বংস। আর রামেশ্বর সেতু বন্ধ হলো কিছু ভৌগোলিক সীমানা পরিবর্তন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন